জীবনের শুরুটা কতটা দারুণ হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? অমর্ত্য সেনের নামের প্রথম অংশের অর্থ সংস্কৃতভাষায় অমর। স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নামকরণ করেন ১৯৩৩ সালে। সেন পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে রবিঠাকুরের স্কুলে পড়াশোনা করে বড় হয়েছেন। স্কুলটি বিশ্বকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সম্প্রীতির বাহুডোরে একত্রিত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কবির দেখানো পথে স্কুলটি পরিচালনা করতেন সেনের দাদা। খোলা প্রাঙণে পাঠদান। মারধর করা যাবে না। সহ-শিক্ষামূলক পরিবেশ। স্বাধীনতা। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা। জাতীয়তাবাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয় সেখানে। অমর্ত্যের মা অমিতা রবিঠাকুরের শ্লোকনাটকে নেচেছিলেন কলকাতায়। এই নারী সেই আমলে জুডোও শিখেছিলেন।

পুরো জীবনজুড়ে দর্শন, উন্নয়ন আর সামাজিক পছন্দ তত্ত্ব বা সোশাল চয়েস থিওরী নিয়ে কাজ করলেও অমর্ত্য সেনের পুরো জীবনে আমরা একটাই ছাপ দেখতে পাই। সারাটি জীবন যেন রবিঠাকুরের মন্ত্র জপে গেলেন তিনি। এই স্মৃতিকথায়, তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন কবিগুরুকে নিয়ে। পশ্চিম আদর্শ নিয়ে কবিকে ভুল বোঝানো হয়েছিল। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো সমালোচকদের চোখে পশ্চিমকে কবিগুরু দেখেছিলেন। পশ্চিমে কবিগুরুকে রহস্যবাদী হিসাবে দেখা হয়। যে কারণে কবিগুরুর যুক্তি ও স্বাধীনতার উপর ভাষ্য, এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তার বিশ্বাসের কথা পশ্চিমে অনুপস্থিত। কবিগুরুর তো আসলে ঐশ্বরিক কোন ক্ষমতা ছিল না। মহাত্মা গান্ধী যখন ১৯৩৪ সালের বিহারের ভূমিকম্প ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রেরিত শাস্তি বলে দাবি করেন, তখন কবি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। কবিগুরু মহাত্মা গান্ধীর চরকা দিয়ে মন প্রশান্তির কৌশলে অনুরক্ত ছিলেন। কবিগুরু চরকা ঘোরানোকে শ্রমসাধ্য কাজ মনে করতেন।
শান্তিনিকেতনে হিন্দুতত্ব (বি. দ্র. ধর্ম ও তত্বের বিষয়টি নিয়ে বোঝার পার্থক্য আছে আমার) পড়ানো হত। আসলে তা ছিল লোকায়ত ধরণের। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর আদর্শে এই হিন্দুতত্ব বিকশিত হয়। এই আদর্শ সম্পূর্ণরূপে নাস্তিক, বস্তুবাদী এবং কেন্দ্রিভুত ছিল। সমসাময়িক গ্রীসের প্রিসোক্র্যাটিকদের মত নয়। দর্শনের এই দুটি প্রাচীন ধারণা কিভাবে সমান্তরালভাবে এগিয়ে তা আসলে বিস্ময়কর। অমর্ত্য সেনের শৈশব ও কৈশোরের সেই সময় সুখকর ছিল বলা যায়, এ কারণে সেই দিনগুলিতে এক মুহুর্তের জন্যও তাকে একজন বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতে প্রলুব্ধ হতে হয় নি। সারা জীবন ধরেই অমর্ত্য সেন জীবন ও শিল্পের জন্য রবীঠাকুরের আদর্শের অনুসারী।
সেই সময়ে কখনও কখনও রবীঠাকুর ভোরের আগে অমর্ত্যের দাদা-দাদির কাছে যেতেন। কবিতায় তারা দিনের আগমন শুভেচ্ছা জানাতেন। অমর্ত্য সেন কোটি বাঙালির মতই সবসময় আড্ডায় আসক্ত।
অমর্ত্য সেনের জীবন নানান অধ্যায়ে সংযুক্ত। কখনো কেমব্রিজে, কখনো হার্ভার্ড- এমআইটি থেকে শুরু করে দিল্লি-বার্কলে-ট্রিনিটি কলেজে আমরা চলে যাই। অমর্ত্য সেনের বন্ধুদের পরবর্তীতে আমরা প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠতে দেখি। এখনকার মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে বন্ধুর শিশুকন্যা হিসাবে স্মরণ করতে দেখি আমরা। অমর্ত্য সেনের মধ্যে আমরা অদম্য এক দৃঢ় সংকল্প খেয়াল করি। নানান আদর্শে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আমরা তার বন্ধুত্ব হতে দেখি। তার কাছে অর্থনীতি অস্বস্তিকর বিজ্ঞান নয়, তিনি অর্থনীতিকে দেখছেন মানবীয় ও মজার হিসেবে।
অমর্ত্য সেনের হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড বইটি আধুনিক পাঠকের জন্য সুখপাঠ্য। অমর্ত্য সেনের অনুকরণীয় জীবন। পুরো পৃথিবীকেই তিনি গৃহ মনে করছেন। তিনি হয়তো কোনও জায়গার নাগরিক নন, কিংবা সবজায়গার নাগরিক। আমরা কি তার মত ধর্মকে একটু পাশে রেখে মানবাত্মার সঙ্গে যুক্ত হতে পারি?
বাংলাদেশের পাঠকেরা অনলাইন থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারছেন।
-- Stay cool. Embrace weird.