যারা নব্বই দশকের শিশু-কিশোর তাদের মনে বাংলা সিনেমা নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে। বাংলা সিনেমার শুরুতে ‘শ্রেষ্ঠাংশে’ নায়ক-নায়িকাসহ সব কুশীলবের নামের পরে ‘সম্পাদনা, গ্রন্থনা, চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনা’ ট্যাগের পরে ‘ছটুক আহমেদ’ বা ‘এহতেশাম’ বা ‘অমুক-তমুক’ থাকতো। একই লোক কত লোকের ভাত মেরে দিতো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারতো। একাই যে সব করা উচিত না তা বর্তমানের বাংলা সিনেমা দেখলেই বোঝা যায়।
এই কথা বলার কারন হচ্ছে, বড়দের কেন ছোটদের কাজ করতে হবে?
বড়দের কেন ছোটদের কাজ করতে হবে?
ধরা যাক, একটা অফিসের বস অফিসের সব কাজ করবে। ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে লিফটম্যানের কাজ-সবই করবে সে। তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে? অফিসের ক্লিনার, লিফটম্যান সবার বেতন সেই বসের পকেটেই যাবে। এই সমীকরণ খুব ছোট মনে হলেও বড় করে দেখলে একটু চমকাতে হবে মনে হয়। যে লোকটা ক্লিনারের কাজ করতে পারতো, সে বেকার থাকবে। যে লোকটা লিফটম্যান হতে পারতো সে চাকরি পাবে না। এই দুইজন যখন চাকরি পাবে না, তখন দুইজনের মত দুই লাখ মানুষ চাকরি পাবে না শুধু ওই বসের সব করার অংকের জন্য।
এই কাল্পনিক ঘটনার সঙ্গে আমাদের দেশের নিচের দিকের অর্থনীতির কথা তুলনা করা যায়। আগে পাড়ায় পাড়ায় ব্রেডের দোকান ছিল, কেকের ছোটখাটো দোকান ছিল। যেখানে ১০-১৫ জন মানুষ কাজ করতো। প্রাণসহ বেশ বড় বড় কোম্পানি এখন ব্রেড তৈরি করছে। ব্রেডের মতই ঝালমুড়ি, সিঙ্গারা, কেক, জ্যাম-জেলির ব্রেডও তৈরি করে বাজার সয়লাব করে ফেলছে বড় বড় কোম্পানিগুলো। এতে আসলে সেই মহল্লার ছোট দোকানগুলো কিন্তু হাওয়া হয়ে যেতে শুরু করেছে। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সেই দোকানগুলোর দরকার নাই। এখন প্যাকেটের স্বাস্থ্যকর ব্রেড-কেকই ভালো। প্রাণ কিংবা অন্যসব বড়রা যখন ছোট ব্যবসায়ীদের পণ্য নিয়ে বাজার দখল করছে, তখন কিন্তু সেই মানুষগুলো চাকরিশূণ্য হচ্ছে। পাড়া-মহল্লার কারখানায় তৈরি ব্রেড-পাউরুটির স্বাস্থ্যমান উন্নত করার জন্য প্রশাসনের নজরদারী বাড়ানো যেতে পারে।
ব্র্যাক বিজনেজ স্কুলের শামীম এহসানুল হক স্যারের সঙ্গে কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে এ নিয়ে ছোট আলোচনা করেছিলাম। ছোটদের বাঁচাতে রাষ্ট্রকেই নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী। অস্ট্রেলিয়াতেও নাকি ছোট ব্যবসায়ীদের রক্ষার জন্য আইন আছে।
বড়দের সুযোগ করে দিতে যেয়ে ছোটদের শূণ্যে মিলিয়ে দেয়ার কোন যুক্তি কি আছে? যে লোকটা ঝালমুড়ি বিক্রি করে দিন কাটায়, প্রাণ তার বাজারও নষ্ট করে দিচ্ছে না? সেই ঝালমুড়িওয়ালার মুড়ির গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাই বলে তাকে বড় অর্থনীতির অংকে গায়েব করে দেয়ার যুক্তি কি আছে?
অর্থনীতির অংকে ছোটদের গায়েব করে দেয়ার যুক্তি কি আছে?
বিভিন্ন শপিংমলের সামনের দিকে আইসক্রিমওয়ালা দেখতে পাওয়া যায়। যারা বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে আইসক্রিম কিনে নিজেরা বিক্রি করে। একদশক আগেও হাতে তৈরি আইসক্রিমের চল থাকলেও এখন আইসক্রিমের গাড়ির মামারা কিন্তু সেই আইসক্রিম বিক্রি করে দিন চলে। কোম্পানিগুলো যদি নিজেই গাড়ি নামানো শুরু করে তাহলে কেমন দেখাবে বলেন তো? সেই মামারা কিন্তু বেকার হয়ে যাবে।
এই ক’দিন আগে গ্রামীণফোনের ইকমার্সে আসা নিয়ে অনেক কাটাকাটি দেখেছি। বিষয়টা কিন্তু সেই রকমই। বড়দের সব দিকে তাকানো ঠিক না মনে হয়।
আমাদের দেশের সামাজিক নিরাপত্তা মডেলটা অনেক দুর্বল। জিডিপি বাড়ার দিকে নজর সবার, সামাজিক নিরাপত্তার দিকে পলিসি মেকার, রিসার্চার-সবারই উদাসীনতা হতাশাই কিন্তু।
সময় যত যাবে, অটোমেশন তত বাড়বে। চাকরি হারাবে মানুষ। অটোমেশনের যন্ত্রপাতি তৈরি থেকে পরিচালনা করার কাজটি যদি বাংলাদেশিরা করে তবে টিকতে পারবেন কিছুটা। ভাইসাব, মনে রাখবেন, দেশে প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমশক্তিতে ঢুকে। কিন্তু চাকরি পায় দেড়লাখ মানুষ। বাকিদেরকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হয়।