ইদানিং যুদ্ধ আর রণকৌশল নিয়ে দারুণ কিছু বই পড়ছি। ব্যবসার দুনিয়াতে কৌশল আর যুদ্ধের রণাঙ্গনের কৌশল তো একই, তাই না? লক্ষ্য একটাই বিজয়। এক্সট্রিম ওনারশিপ নামের একটা বই পড়ছি এখন, সেই বইকেই বেইজ ধরে বাংলাদেশ আর্মি থেকে নেতৃত্ব শেখার যে পয়েন্টসগুলো জানতে পারেন তা নিয়ে এই লেখাটি দাঁড় করাচ্ছি।
১. সব দায় লিডারের
যা হবে, যা হয়েছে-তার সব দায় আপনারই। আপনার টিমের কেউ যদি আপনার নির্দেশনা না বোঝে তাহলে টিম লিডার হিসেবে আপনি তাকে দোষারোপ করতে পারেন না। নেতা হিসেবে আপনার দায় হচ্ছে দলের সব সদস্যকে সব কিছু বুঝিয়ে দেয়া। যুদ্ধের সময়, আপনার দলের কোন সৈনিক আপনার কথা যদি না বুঝতে পারে তাহলে কত বড় বিপর্যয় হতে পারে তা কি ভেবেছেন? একই কথা আসে ব্যবসার দুনিয়াতে। আপনার কোন কর্মী যদি আপনার কথা না বুঝতে পারে তাহলে তার দায় আপনারই। আপনাকে শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে কিভাবে আপনার কথা আপনার দলের সদস্যরা বুঝবে। আপনার দলের সদস্য আপনার কাছে না এলেও আপনাকে তার কাছে যেতে হবে, তাকে বুঝাতে হবে। হলিউডের মুভিতে দেখেন না, সিনেমায় মিশনে যাওয়ার আগে মেজর কিংবা কমান্ডেন্ট বারবার একই কথা তার টিমের সদস্যদের কেন বলে? বলা কথার জোর অনেক বেশি কিন্তু!
আপনি হয়তো ভেবে আছেন, আপনার অফিসের কর্মী আপনার কথা সব বুঝে যায়। বাস্তবতা আসলে বেশ ভিন্ন। বারবার আপনার কাজের লক্ষ্য, সাফল্যের শীর্ষ কোথায় তা আপনার দলের সদস্যদের বুঝিয়ে বলুন। আপনি যদি আপনার কাজের সাফল্য আনতে চান, তাহলে পুরোপুরো দায় নিয়ে নিজের মধ্যে চুম্বকের মত ডায়নামিজম তৈরি করুন।
ভাবনার প্রশ্ন: আপনার কর্মীকে ব্যর্থতার জন্য দিনে দশবার কথা না শুনিয়ে তাকে কি কখনও একই বিষয় ৩ বার বুঝিয়ে বলেছেন? সমস্যা নিয়ে ভাবনার চেয়ে সমাধান নিয়ে তাকে ভাবতে উৎসাহ দিয়েছেন কি?
২. খারাপ টিম বলে কোন কথা নেই, সব খারাপ আসলে লিডারই
সেনাবাহিনীর সব সদস্যই শুরু থেকে দল হিসেবে কাজের শিক্ষা পায়। আমাদের অফিসগুলোতে যে যার মত আলাদা আলাদা কাজ করে দুনিয়া উদ্ধার করে। সেনাবাহিনীতে কখনই কখনই একক কোন কাজের দৃষ্টান্ত আনতে পারবেন না, সবাই টিম। ভাবুন তো, আপনি আর্মির কোন একটি টিমের লিডার, আপনার দলের সবাই আলাদা আলাদা কাজে ওস্তাদ। সবাই র্যাম্বো, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ মাঠে কি হবে? মনে রাখা উচিত, যারা বীর হিসেবে স্বীকৃত তারা সবাই দারুণ কোন একটি দলের সদস্য ছিলেন। আমাদের বীরশ্রেষ্টদের যুদ্ধের ঘটনাগুলো পড়তে পারেন। বীরশ্রেষ্ট মতিউর রহমান ছাড়া বাকি সবাই কোন না কোন টিমের সদস্য ছিলেন। সিপাহী নূর মোহাম্মদ বীরশ্রেষ্ট মানে কিন্তু তার সেই টিমের সবাই এক!
আপনার টিমের সাফল্য নির্ভর করছে আপনার উপর। টিম খারাপ ছিল, এটা মূর্খদের এক্সকিউজ। মরিস ওদুম্বে নামে কেনিয়ার একজন ক্রিকেটার ছিলেন, তার সময়ের সেরা ক্রিকেটার। কেনিয়া দল খারাপ ছিল, কিন্তু সে ভালো ছিল। সে ভালো থাকলে কি হবে? কেনিয়া কি ভালো করেছে কিনা তাই ভাবার বিষয়!
১৯৯৪ সালে বসনিয়াতে বাংলাদেশ আর্মির কমান্ডার ন্যাটোর সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়েছিল। সেবার একজন সৈনিক হারিয়েছিল বাংলাদেশ আর্মি। লিডারের ভূমিকাই সব।
(ফেসবুকে আমি ভুলে একশ জন সৈনিক হারানোর কথা লিখেছিলাম, উইকিপিডিয়া থেকে পড়ার সময় ভুল বুঝেছিলাম আমি। দুঃখিত।)
হয় নেতৃত্ব দিতে শিখুন, কিংবা শেখার জন্য বই পড়ুন। শেখ মুজিবুর রহমান এক দিনে নেতা হয়েছেন?
যে কোন যুদ্ধে পরাজিত হলে কার দোষ হয় বলুন তো? ইয়াহিয়া খানের, সেনাপ্রধানের। তাহলে ব্যবসার ক্ষেত্রে দায় কেন টিমের সদস্যদের উপর দিচ্ছেন?
৩. শুরুটা আপনারই করতে হবে
টিমে কাজ করার সময় নেতা হিসেবে আমাদের কথা কেউ না শুনলে আমরা “বসের অর্ডার” কিংবা উপরের অর্ডার বলে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেই কথা বার্তা। আপনার উপরে টিমের বিশ্বাস থাকে না বলেই কিন্তু আপনাকে হাইকোর্ট দেখাতে হচ্ছে!
সেনাবাহিনীতে কি এমনটা হতে শুনেছেন? ট্রেনিংয়ের প্রথম দিন থেকেই নেতার কথা শুনতে হবে এমনটাই মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। নেতার মনস্তত্বের উপরে ভরসার কথা বলা হয়। আবার যিনি নেতা হবেন তাকেও এমনভাবে ট্রেনিং দেয়া হয় যেন তার উপরে সবার শ্রদ্ধা আর ভরসা তৈরি হয়। অনাস্থা কিন্তু সেনাবাহিনীতে ভয়ানক একটি রোগ। আপনার উপর একবার অনাস্থা তৈরি হলে আপনি সম্ভবত সেনাবাহিনীতে আর টিকবেন না!
অফিসগুলোতে কি দেখি আমরা? যে টিমলিডার থাকে তার উপরই যত অনাস্থা! টিমের কর্মীদের মধ্যে কেন টিমলিডার কিছুই পারে না বলে ধারণা তৈরি হয়?
আপনি যদি নিজের টিমের মধ্যে লিডারশিপের জায়গা তৈরি করতে চান, তাহলে আপনি উপরের সিদ্ধান্তে কাজ করছেন এমন কোন কারণ তৈরি করবেন না।
৪. নিজের ইগো সম্পর্কে সতর্ক থাকুন
সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরাসরি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ভাবুন তো সেখানে আপনি মেজর পদমর্যাদার কোন অফিসার। আপনার কোন কলিগের সঙ্গে আপনার “শো অফ” ক্রাইসিস আছে। সেই কলিগ কারও কথা শুনেন না, তার সঙ্গে কোন সৈনিক কেউ যুদ্ধমাঠে যেতে চান না। তাহলে পরিস্থিতি কি হবে ভাবুন তো?
আমাদের অফিসগুলোতে কিন্তু এমন অনেক কর্মী আছেন, কিংবা আপনিই সেই টিমলিডার যার সঙ্গে কেউ কাজ করতে চান না। আপনি ম্যানেজার পদের মানুষ বলে সবার সঙ্গে খারাপ বিহেইভ করেন, ইগোর কারণে মাটিতে পা পড়ে না। সেনাবাহিনীতে এমন হলে পরিস্থিতি কি হবে ভাবুন তো?
সেনা অফিসাররা অনেকেই অনেক সৈনিকের চেয়ে বয়সে কম। তার নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তার অধীনস্ত টিম কি সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারবে?
“আমি সব জানি”, এমন বস বা টিম লিডার অফিসে থাকবেই। সেনাবাহিনীতে এমন অফিসার থাকলে কি বিপত্তি হবে তা ভাবুন একবার!
৫. কভার অ্যান্ড মুভ
সেনাবাহিনীতে কভার অ্যান্ড মুভ নামের একটা যুদ্ধ স্ট্র্যাটেজি আছে। গোলাগুলি চলুক না চলুক আপনি যখন সামনে এগোবেন তখন সব সময় আপনার যে সদস্যরা সামনে এগোচ্ছে তাদের কেউ না কেউ কভার করছে।
এ সময় আরেকটা স্ট্র্যাটেজি কাজে লাগানো হয়, সাধারণভাবে আমরা হেটে চলার সময় এক পা সামনের মাটিয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরের পা তুলে হেটে যাই এমনটার উল্টো! আপনি প্রথমে প্রথম পা ফেলবেন, তা পুরোপুরি মাটিতে রেখে তারপরে দ্বিতীয় পা সামনে বাড়াবেন!
আমরা অফিসে টিমলিডাররা কি করি? নিজের কাজ করে সামনে এগিয়ে যাই। যুদ্ধের মাঠে এমনটা করলে কি হবে বলুন তো! যুদ্ধের মাঠে প্রত্যেক সেনাসদস্য যেমন নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তেমনি নিজের সহযোদ্ধারও। অফিসে এমনটা করার চর্চা প্রয়োজন আমাদের। এতে নেতার প্রতি সবার বিশ্বাস তৈরি হয়।
৬. সব কিছু সরল রাখুন
বলা হয়, রণকৌশল যত কঠিন যুদ্ধে জেতা তত কঠিন। সব সোজা আর সরল রাখা হয় যুদ্ধ কৌশলে, যেন সৈনিকরা সবাই সব কিছু বুঝতে পারে।
অফিসে কি হয়? একটা পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে চার্ট আর চার্ট দিয়ে ভরে ফেলি আমরা। তারপরে তার সাতসমুদ্রের যতজ্ঞান আছে তা নিয়ে ভয়ানক একটা স্ট্র্যাটেজি তৈরি করি! এতে ভরকে যায় আপনার টিমমেইটরা!
অ্যাপল কিন্তু দুনিয়া সেরা সাফল্য পেয়েছে তার সরল ডিজাইনের জন্য!
আরও পড়ুন:
তাহসান থেকে হবু-উদ্যোক্তারা যা শিখতে পারেন
-- Stay cool. Embrace weird.
1 thought on “বাংলাদেশ আর্মি থেকে যেসব নেতৃত্বগুণ শিখতে পারেন”