অ্যান্ড্রু রবিনসনের সত্যজিৎ রায়: দ্য ইনার আই বইটি দারুণ একটি একটি প্রয়াস বলা যায়। একজন লেখক, একজন সুরকার, একজন শিল্পী এবং একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, যোগফল চারজন ব্যক্তিমানসকে একটি বইয়ে প্রকাশ করা কঠিনই বটে। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা বিশ্বমানের। চলচ্চিত্রের ফ্রেমে ফ্রেমে তুলনামূলকভাবে অস্পষ্ট ভাষায় তিনি তৈরি করেছেন বাস্তব দুনিয়ার প্রতি-বাস্তব এক দুনিয়া।
প্রভাবশারী চলচ্চিত্র পরিচালকদের তালিকা সংকলন করার সময় সত্যজিৎ রায়ের নাম উল্লেখ করার মতো। আপনার চারপাশে খোঁজ নিলে দেখবেন, এমন নয় যে অনেকেই তার চলচ্চিত্র দেখেছেন। তার প্রথম দিকের চলচ্চিত্র অপু ট্রিলজি সুপরিচিত। সত্যজিৎ ৩৭টি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন। পুরো ভারতবর্ষে তার সিনেমা খুব প্রচারিত নয়, আর পশ্চিমে এখন তো অজানা বিস্মৃতির নাম তিনি। সত্যজিৎ ছিলেন বাঙালি, কলকাতার মানুষ। তিনি বাংলায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পছন্দ করতেন, বাংলায় কথা বলতেন। তিনি বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে লাখ লাখ রুপি নিশ্চিত মিস করেছেন। ভারতের হিসেবে বাংলা একটি সংখ্যালঘু ভাষা। মাত্র ৭ ভাগ ভারতীয়র ভাষা বাংলা। আর খুব কম ভারতীয় বাংলা বোঝে। অন্যদিকে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রগুলি পশ্চিমা চলচ্চিত্র দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তার চলচ্চিত্র পশ্চিমের দেশে আলোচনায় থাকে। বাঙ্গালির জন্য তিনি অনেক সুস্পষ্ট সূক্ষ্মতা, ইঙ্গিত ও রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন। পশ্চিমা দর্শকেরা কী সেই ইঙ্গিত সাবটাইটাইলের মধ্যে বুঝতে পারেন?
রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে আর্দশ বাঙালি হিসেবে আমি সত্যজিৎকে ভাবতে চাই। তার মধ্যে একজন বাঙালির ছাপ ও শক্তি দেখি আমি। সত্যজিৎ রায় কী একজন? বহুজনের ছাপ দেখা যায় তো তার মধ্যে?
সত্যজিৎ রায়ের বাঙালি অঞ্চলে একজন সর্বাধিক বিক্রিত ও অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক। এক হাতে কলম চালিয়ে গোয়েন্দা, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী আর শিশু সাহিত্যে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। লেখা আর শিল্প-সাহিত্য ছিল তার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। তাঁর গল্প আর চরিত্রগুলি কেবল জনপ্রিয় নয়, তবে মৌলিকত্ব নিয়ে সমালোচনা আছে। তার উপর পশ্চিমা প্রভাব প্রবল ছিল। ব্রিটিশ লেখক আর্থার কোনান ডয়েলের প্রচুর প্রশংসা করতেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের গল্পের বাঙালি ভক্ত অনেক। এমনকি সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রকে জানেন না এমন মানুষও তার গল্প পড়েছেন। সত্যজিৎ কিন্তু দারুণ একজন সমালোচকও ছিলেন। নিজের সিনেমাসহ সিনেমা নিয়ে লেখা তাঁর লেখা চলচ্চিত্রের মতোই উপলব্ধিমূলক।
একজন গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু। তার টাইপফেস এখনও ব্যবহৃত হয়। তার বইয়ের প্রচ্ছদ এখনও বিখ্যাত। অনেক গল্পের সাথে তার নিজস্ব চিত্র আছে, যা আলাদাভাবে জনপ্রিয়। তিনি একজন চমৎকার ক্যালিগ্রাফার ছিলেন এবং অনেক দর্শক সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের শিরোনামের মাধ্যমে তার কাজের সাথে পরিচিত। তার প্রতিটি চলচ্চিত্র প্রথমে একটি স্টোরিবোর্ড বিন্যাসে তৈরি করা হয়েছিল। যেখানে প্রতিটি দৃশ্যের স্কেচ করা হয়েছিল। তার প্রতিটি বই যেন একটি শিল্পকর্ম।
সত্যজিৎ রায়ের পশ্চিমা ও ভারতীয় উভয় পদ্ধতিতে সিনেমা তৈরিতে সাবলীল ছিল। তিনি ছিলেন স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত একজন সুরকার। তিনি তার বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের স্কোর নিজেই রচনা করেছেন। সত্যজিৎ ছিলেন একজন প্রতিভাধর গানের লেখক। বলিউডের জন্য সেই ৬০-৭০-৮০ আমলে লিখে দারুণ জনপ্রিয় হওয়ার সুযোগ ছিল বটে। ভারতীয় সিনেমা সংস্কৃতিতে গান- ফিল্মি গানের স্থান বেশ জোরালো। তার গান বাঙালির অন্দরমহলে বেশ চলেছে বলা যায়।
সত্যজিৎ রায়কে দুই সংস্কৃতির মানুষ বলা যায়। দুই দুনিয়ার শিল্পকে এক বিন্দুতে এনেছেন। ১৯৩০ দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভ্যতার সংকট লিখেছিলেন, সত্যজিৎ ১৯৫০-১৯৬০ সময়ে তাদের মিলন ঘটনা। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতো তিনি দুটি সংস্কৃতির মধ্যে পড়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের পরিচয় ভারতীয়দের জন্য যথেষ্ট ভারতীয় নয়। আবার পশ্চিমাদের জন্যও প্রবল ভারতীয় কেউ নন তিনি। বিচ্ছিন্নতার সাথে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ছাপে দেখি আমরা তার চলচ্চিত্রে। গান নাচের জন্য ভারতীয় ফিল্ম আলোচিত। আবার পশ্চিমা অ্যাকশন ফিল্ম জনপ্রিয়। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র সেই দিন থেকে খুব ধীর বলা যায়। ফ্যান্টাসি কিংবা গাড়ি তাড়া বা বিস্ফোরণের কোন দৃশ্য তার সিনেমা পাওয়া যাবে না। সত্যজিৎ রায়কে চিনতে জানতে বইটি কার্যকর বলা যায়।
-- Stay cool. Embrace weird.