মানুষ, আপনি-আমি সবাই। সবাই মানুষ, সবার হাত-পা-ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট-আইফোন থাকলেও একটা জিনিষে কমতি কমবেশি সবারই আছে। জ্বি হ্যাঁ, অফিসের বেতন, সবাই তো সমান পায় না। আমার বস গতবছর নতুন এলিয়ন গাড়ি কিনেছে। আমি জানি, এবছর আমি আরও পরিশ্রম করলে বস মার্সেডিজ বেঞ্চ কিনতে পারবেন। আমার জীবনের এই গল্প আপনাদের জীবনেও আছে। আরেকটা জিনিষের কমতি আছে সবারই, কমন সেন্স। স্রষ্টা সবাইকে আকাশ ছোঁয়া জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে পাঠালেও কমন সেন্স কেন জানি সবাইকে সমান দেয় নাই। কমন সেন্স শেখার বিষয় এটা আমরা ভুলে যাই। সেই ভুল থেকেই নিজেকে একটা উচ্চস্থানে চিন্তা করে অন্য পেশার অন্য মানুষদের নিয়ে ভুল ধারণা পোষণ করি। অন্য মানুষদের অসম্মান করার জন্য যা-যা করতে হয়, সবই করি। অন্য পেশার মানুষদের কাজকে শ্রদ্ধা করি না, ভুল জানি, ভুল বুঝি। সেই ভুল থেকেই আমার মানুষ যা ভুল জানে সিরিজ লেখা।
সাংবাদিকদের নিয়ে যা ভুল জানি
১. অনেক ট্যাকার মালিক
যা ভুল জানে মানুষ: সাংবাদিকদের একটু দূরের বন্ধু-বান্ধবরা সব সময় ভাবেন সাংবাদিক মানেই ম্যালা টাকার মালিক।
আসলে যা ঠিক: খুব কম সাংবাদিকই আছেন যারা নিজের বাসা ভাড়া ঠিক সময়ে দিতে পারেন। এটা সত্য, অনেক নামী-দামী সাংবাদিক রোলেক্স ঘড়ি পড়েন, প্রাডো গাড়িতে চড়েন। একটু সিনিয়র সাংবাদিকদের বিভিন্ন আইএনজিওতে কনসালটেন্সি করার সুযোগ থাকে, সে ক্ষেত্রে তারা বিত্তের মালিক হন। সাধারনক্ষেত্রে তরুণ আর মিড-লেভেলের সাংবাদিকদের বেতনের টাকাই জীবিকার প্রথম মাধ্যম। এর বাইরেও অনেক সাংবাদিক বিভিন্ন ব্যবসার মাধ্যমে নিজেকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল রাখছেন।
২. অনেক পাওয়ার
যা ভুল জানে মানুষ: সাংবাদিক মানেই পুলিশ-রাজনীতিবিদের মতই সুপারপাওয়ারের মালিক।
আসলে যা ঠিক: দুই তিন দশক আগেও সাংবাদিকতা পেশার ধার ছিল অনেক। সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের থিওরীটিক্যাল অ্যাসোসিয়েট ছিলেন। এখন পাওয়ার মানেই পুলিশ কিংবা রাজনীতিবিদদের উপর আক্রোশ ছড়ানোই বোঝানো হয়, সাংবাদিকদের সঙ্গে কিন্তু পুলিশ বা রাজনীতিবিদদের কিন্তু তেমন শখ্যতা এখন নেই। বেশির ভাগ সময়ই কোন কোন সাংবাদিক পুলিশ বা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সেলফি তোলেন, তা দেখে সেই সাংবাদিককে পাওয়ারফুল ভাবা কি ঠিক? এটা অস্বীকার করবো না, কেউ কেউ হয়তো পুলিশ কিংবা রাজনীতিবিদদের পাওয়ার দেখান, সবাই কিন্তু না।
৩. অশিক্ষিত সাংবাদিক
যা ভুল জানে মানুষ: সাংবাদিকরা বেশির ভাগই অশিক্ষিত।
আসলে যা ঠিক: অশিক্ষিতের ডেফিনেশন তেমনটা জানি না। কিন্তু ‘অশিক্ষিত সাংবাদিক’ শব্দটা দারুণভাবে জনপ্রিয়। ঢাকার বিভিন্ন টিভি স্টেশন আর পত্রিকার নিউজরুমের কথা বলতে পারি। মোটামুটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়া লোকজনই কিন্তু সাংবাদিকতায় আছেন, কেউ কেউ কিন্তু পিএইচডি, মাস্টার্স বা এমবিএও করা সাংবাদিক। এটা বলতে পারেন যে, সাংবাদিকতা কিংবা গণযোগাযোগে না পড়ে সাংবাদিক হন প্রায় লোকই, কিন্তু সাবজেক্ট নলেজ বা সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্ট হিসেবে কিন্তু অনেকেই সাংবাদিকতা করেন।
৪. জীবনে কিছুই করতে পারে নাই দেখে সাংবাদিক
যা ভুল জানে মানুষ: আরেহ ও তো আমার বন্ধু, কিছু করতে পারতেছে না দেখে সাংবাদিকতা করছে।
আসলে যা ঠিক: এই ভুল ধরনা সাংবাদিকদের বন্ধু-বান্ধব আর পরিবারের লোকজনই ছড়ায়। কেউ হয়তো অনার্স-মাস্টার্স পড়ার সময়ই সাংবাদিকতা শুরু করেন। পড়া শেষ করেই হয়তো সেখানে জয়েন করে ফেলেন। এক সময় সাংবাদিক ছিলেন, এখন বেসরকারী ব্যাংকে চাকরি করছেন এমন মানুষ আপনি খোঁজ নিলেই আশেপাশে পাবেন।
৫. ঠিক মতো বেতন পায় না
এটা কিন্তু একটু আধা-সত্য কথা। বেশির ভাগ পত্রিকা-টিভিতে মাসের ১৫ তারিখের দিকে বেতন দেয়া হয়, সে কারণে মাসের শুরুতেই অন্য সব পেশার মানুষদের মত সাংবাদিকদের বেতন দেয়া হয় না।
৬. পেনড্রাইভ, ফোন- এসব গিফটের মালে জীবন চলে
সাংবাদিকরা বিভিন্ন ইভেন্ট কাভারের সময় নানান ধরনের গিফট পেয়ে থাকেন, সেটা কিন্তু সবাই না। সেক্ষেত্রে কোন সাংবাদিকের পেনড্রাইভ কিংবা শখের ক্যামেরা দেখে গিফট ভাবাটা কমনসেন্সের কমতিই বলা যায়।
৭. দোস্ত, তুই তো সাংবাদিক। কনসার্ট/সিনেমা হলের ফ্রি টিকেট দে
এই আবদার এমন কোন নবীন সাংবাদিক যে শোনেন না তা খুঁজে বের করা মুশকিল। সত্যটা হলো, কোন সিনেমার প্রিমিয়ারের সময় সিনেমার পরিচালক প্রায় সব নামী পত্রিকা আর টিভি স্টেশনের সিনিয়র সাংবাদিকদের টিকেট পাঠান। তাও সর্বোচ্চ ২টা হয়তো টিকেট। ব্যস্ততার কারণে সেই সাংবাদিকরা বেশির ভাগ সময়ই টিকেট দিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে পারেন না। (একটা আড়ালের খোঁজ দেই, নামী ব্র্যান্ডের মার্কেটিং বিভাগের লোকজন কিন্তু বেশি কমপ্লিমেন্টারি টিকেট পান)
৮. চরিত্র খারাপ
কোন পেশার ৪৯ ভাগ লোকও যদি খারাপ হয়, তাদের রেফারেন্স বাকি ৫১ভাগ লোককে বানের জলের মত খারাপ ভাবা কিংবা বলা ঠিক না কিন্তু।
৯. ডেডিকেশন নাই
এ ধারণাকেও ভুল বলা যায়। নিজের জব ডেসক্রিপশন সব সাংবাদিকই জানেন।
১০. কাজ-কাম না করেই বেতন পায়
আপনি হয়তো দেখেন আপনার সাংবাদিক বন্ধু খালি ঘোরে, কাজ নাই। আপনি হয়তো জানেন না, সেই বন্ধু সেই সাত সকালে একটা ক্যামেরা-বুম কিংবা কলম নিয়ে বের হন।
১১. টাকা খেয়ে নিউজ করে
এই ধারণার উৎপত্তিও কমনসেন্সের কমতি থেকে। কোন সাংবাদিক টাকা খেয়ে নিউজ করে, সেটা তার স্টেশনের লোকজন জানলে তার কি চাকরি থাকবে বলেন? টাকা খেয়ে নিউজ করার বিষয়টা আসলে ঢাকার বাইরে বেশি প্রচলিত। সেখানে কোন ইভেন্টে সাংবাদিক গেলেই খামে কিছু একটা ধরিয়ে দেয়া হয়। বেশির ভাগ সময়ই সাংবাদিকরা সেই খাম ফিরিয়ে দেন, সমস্যা বাঁধান যে টাকা দেন সে কিন্তু মিডলম্যান থাকে। সে যদি টাকা সরিয়ে সাংবাদিকের নাম ভাঙান সেক্ষেত্রে সাংবাদিকের দোষ কোথায়?
রাজনৈতিক কোন মিছিলেও একইভাবে টাকা বা খাম দেয়ার কথা শোনা যায়। দলের নেত্রী বা নেতাদের টানতে অনেকেই চেহারা দেখানোর জন্য অনুরোধ করেন, খাম দেন। সাংবাদিকরা সেই খাম না নিয়ে সেই গল্প নিজের ঝুলিয়ে জমা করেন। টাকা নিয়ে চুপে চুপে থাকার গল্পের চেয়ে টাকার খাম ফিরিয়ে দেয়ার গল্প প্রায় সব সাংবাদিকের জীবনে আছে, এতেই কিন্তু আনন্দ বেশি।
১২. পলিটিশিয়ানদের ব্ল্যাকমেইল করে
সবক্ষেত্রে সবার জন্য এই ধারণা সত্য না কিন্তু!
১৩. নারীপ্রীতি আছে
৭৮ জনের দোষের জন্য পুরো পেশাকেই অসম্মান করা ননসেন্স না?
১৪. সুন্দর মেয়েরা চোখে লাইগা থাকে
গণমাধ্যমে জেন্ডার ইস্যুটা সব সময় আলোচিত। এটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এইচএসসি বা এসএসসির রেজাল্টের সময়।
১৫. কথা রাখে না
১৬. টাকা ধার নিয়ে আর দেয় না
৭৮ জনের দোষের জন্য পুরো পেশাকেই অসম্মান করা ননসেন্স না?
১৭. সাংবাদিকদের বাড়িভাড়া লাগে?
এটা একটা অদ্ভুত ধারণা। সাংবাদিকরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়তো কেউ কেউ সরকারী ফ্ল্যাট কোটায় পেয়ে থাকেন, কিন্তু মোটামুটি সব সাংবাদিকেরই একটা বাসায় থাকতে হয়। বেশির ভাগ সাংবাদিকের সঙ্গেই তার বাড়িওয়ালার মোটামুটি একটু খারাপ সম্পর্ক থাকে। মাসের ১৫ তারিখে যে বেতন পায়, সে কি আর সবার মত ৫ তারিখের মধ্যে বেতন দিতে পারে?
১৮. অমুকের টিভি চ্যানেলের চামচা সাংবাদিক
মোটামুটি সব টিভি বা পত্রিকার মালিক বড় কোন গ্রুপ। সে ক্ষেত্রে ‘অমুকের চামচা’ এটা প্রায়শই সবাই শোনেন। যে নুন দেন, তার হয়ে গালি খাওয়াটার ঘটনা সব সাংবাদিকই ফেস করেন।
১৯. ওরে দাওয়াত দিয়ে লাভ কি?
বিভিন্ন বিয়ে-জন্মদিনে সাংবাদিক বন্ধুদের প্রায় সময়ই অ্যাভোয়েড করার একটা মানসিকতা দেখা যায়। বন্ধুদের কোন গেটটুগেদারে সবচেয়ে আগে লিস্টি থেকে বাদ পড়েন সাংবাদিক। বেশির ভাগ সাংবাদিকই আজ দুপুরেও জানেন না,তার আগামীকালের অ্যাসাইনমেন্ট কি। একারণে অনেকেই বিভিন্ন দাওয়াতে কথা দিয়েও যেতে পারেন না।
২০. ওর গাড়ি তো শ্বশুড়বাড়ির গিফট!
এটাও অনেক সাংবাদিককে শুনতে হয়। ২০০০ সালের পরের সাংবাদিকদের বেশির ভাগেরই সহধর্মীনি কিন্তু নানান পেশায় যুক্ত আছেন। সেক্ষেত্রে সাংবাদিকরা হয়তো গাড়ি কেনেন, সেটা না জেনে ঢালাও মন্তব্য না করাই ভালো।
২১. ও তো কাট-কপি-পেস্টের সাংবাদিক
‘আরেহ সব নিউজ তো অনলাইনেই পাওয়া যায়, ও তো কাট-কপি-পেস্ট করে’-এই ধারণা তাদের মধ্যেই বেশি থাকে যারা গণমাধ্যম আর ফেসবুক পেইজের মধ্যে পার্থক্য করতে জানেন না। আপনি যদি ফেসবুকে ১০ লাখ লাইকওয়ালা কোন পেইজের আপলোড করা লিংককে কোন গণমাধ্যমে কাজ করা সাংবাদিকের নিউজের সঙ্গে তুলনা করেন তাহলে বিষয়টা হাস্যকর মনে হয় না?
—
আরও কোন ভুল ধারণা থাকলে শেয়ার করতে পারেন। সাংবাদিকতা পেশায় যে সবাই নিখুঁত তা প্রমানের জন্য এই পোস্ট না। দোষ-ত্রুটি সব পেশাতেই থাকে, থাকবে। ঢালাওভাবে অন্য পেশার পেশাজীবিদের সম্পর্কে অসম্মান জন্মে এমন মন্তব্য না করাই কিন্তু সেই পেশাজীবিকে মানুষ হিসেবে সম্মান দেয়া। স্রষ্টা সবাইকে কমনসেন্স বিষয়টা বুঝবার সক্ষমতা দিক।
(এই লেখার বেশির ভাগ ছবিই বিভিন্ন সাংবাদিকের ফেসবুকের প্রোফাইল থেকে সংগৃহীত। কোন প্রকারের বিবেচনা ছাড়া আমার ফ্রেন্ড লিস্টের নামী সাংবাদিকদের প্রোফাইল থেকেই সম্পর্কের পূর্বজোরেই ছবিগুলো নিয়েছি।)
-- Stay cool. Embrace weird.