সম্মানিত আচার্য, উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অতিথিবৃন্দ ও শিক্ষার্থী-সবাইকে শুভ অপরাহ্ণ। আমি নিজেকে ভীষণভাবে সম্মানিত মনে করছি এমন একটি ঐতিহ্যবাহী আয়োজনের সঙ্গে থাকতে পেরে। হংকং বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে যে সম্মান ও বিশ্বাস করেছে তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
আপনারা জানেন, আমি অনেকবার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির চেষ্টা করেছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে তিন-তিনবার ব্যর্থ হই। আমি কখনই ভাবি নি যে আমি পিএইচডি অব অনার ডিগ্রি অর্জন করতে পারবো। আমি আসলে চেষ্টা করেছি কঠিন ভাবে, আমি বারবার পরীক্ষায় ফেল করেছি। আমার গল্প সেই সব মানুষের জন্য যারা চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন বারবার। হাল ছাড়া যাবে না। আপনার জন্য কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয় সামনে অপেক্ষা করছে।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গায় কথা বলতে পেরে ভীষণ সম্মানিত বোধ করছি। আমাকে এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি অধ্যাপক চার্লস শেনকিংকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন আসলে আমি ভালো বলে পাইনি, আমি আসলে যোগ্য বলেও এই সম্মান পাইনি। আমি যোগ্য হওয়ার জন্য কঠিন পরিশ্রম করে যাচ্ছি নিজেকে যোগ্য প্রমাণের জন্য। একদিন আমি যোগ্য হবই।
আমার পিএইচডি ডিগ্রি আমার জন্য কোন স্বীকৃতি বলে মনে করি না আমি, আমার ধারণা এই ডিগ্রি এন্টারপ্রেনারশিপ বিষয়টি স্বীকৃতি দিচ্ছে। ‘হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না’ অনুপ্রেরণাকে আলোড়িত করতেই এমন স্বীকৃতি।
আমি মনে করি, উদ্যোক্তারা হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞান দুনিয়ার বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেক মিল আছে। আমরা ঝুঁকি নেই। আমরা উদ্ভাবনের পেছনে ছুটি। বিজ্ঞানীরা জানেন কিভাবে সব কিছু ঠিক মতো করতে হয়, আর ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা জানেন কিভাবে কোন কিছু কার্যকর ও দক্ষতার সাথে করতে হয়।
সব সাধারণ মানুষ যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। আমাদের মত মানুষেরা আগে বিশ্বাস করে তারপরে আমরা দেখতে পাই। আমরা যখন ব্যবসা শুরু করে আমাদের তেমন অর্থ ছিল না। আমাদের তেমন সম্পদ ছিল না। আমাদের আসলে কোন কিছুই ছিল না। আমাদের কাছে শুধু ছিল একটি মাত্রই বিশ্বাস, আমরা ভবিষ্যতে বিশ্বাস করি। আমাদের স্বপ্ন আছে। আমরা হাজার হাজার ভুল করি। আমরা শুধু একটি কাজেই কখনই ভুল করি না, আর তা হলো কখনও হাল ছেড়ে না দেয়া।
সব ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা অর্থ নিয়ে কথা বলেন। আমি কিন্তু মনে করি সত্যিকারের ব্যবসায়ী, সত্যিকারের উদ্যোক্তা শুধু টাকা আয় করতেই জানেন না, টাকা খরচ করতেও জানেন। আর আমরা তো টাকার জন্য বেঁচে থাকি না, আমরা টাকার জন্য কাজ করি না। যখন আপনার হলও টাকা থাকবে, তা আপনার টাকা হবে। কিন্তু যখন আপনার ১০ লাখ টাকা হবে, তখনই আসলে সমস্যা শুরু হবে। যখন আপনার এক কোটি টাকা হবে, আমি মনে করি সেই টাকা আসলে আপনার টাকা হবে না আর। সেই টাকা হচ্ছে আসলে সমাজের বিশ্বাস, সমাজ আপনাকে বিশ্বাস করে টাকা দিচ্ছে। সমাজ বিশ্বাস করে আপনি অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করতে পারবেন, আপনি অর্থ সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা জানেন। তো, সত্যিকারের ব্যবসায়ী ভুল থেকে টাকা তৈরি করে না, বিভিন্ন সমস্যা-সামাজিক সমস্যাকে ভিত্তি করে টাকা তৈরি করে। সত্যিকারের ব্যবসায়ী টাকা আয় করে অন্যদের সামাজিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে।
আমার নিজের শহর হাংজুর পরে আমি হংকং শহরকে ভীষণ পছন্দ করি। হংকংয়ের তিনটি বিষয় আমার দারুণ লাগে। এই শহরের সংযুক্তি, উদ্ভাবন আর তরুণদের। আমি হংকংয়ের মুক্ত সংস্কৃতি ভীষণ পছন্দ করি। এই শহরের মুক্ত মানসিকতা, মুক্ত ব্যবসা, মুক্ত সংস্কৃতি ভীষণ আকর্ষণীয়। এমন ছোট শহর পৃথিবীতে আর একটিও নেই যেখানে এত ভাষা, এত সংস্কৃতি আর এত বৈচিত্র্য। ছোট বেলায় আমি হংকংয়ের সিনেমা দেখতাম অনেক। আমি কল্পনা করতাম, আমি এক সময় হংকংয়ে আসবো। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি হংকংয়ের তরুণদের বলতে চাই, তোমাদের সারা পৃথিবী নিয়ে ভাবতে হবে। শুধু নিজের পৃথিবী নিয়ে ভাবলে হবে না, অন্যদের সমস্যার সমাধানেও এগিয়ে আসতে হবে। এখন তো পৃথিবীতে অনেক রকমের বিশেষজ্ঞ আছে কিন্তু ভবিষ্যত নিয়ে কোন বিশেষজ্ঞ নেই। সব বিশেষজ্ঞই আসলে গতকালের বিশেষজ্ঞ। একমাত্র কাজ করে-করে আপনার বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ হতে পারি-কোন একদিন।
পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। প্রযুক্তির কারণে পৃথিবীর ব্যবসার ধরণ বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভবিষ্যতের ব্যবসা কিন্তু বিটুসি না, সিটুবি। ভবিষ্যতের ব্যবসা কিন্তু কন্টেইনার নির্ভর না, প্যাকেজ নির্ভর হবে। ভবিষ্যতের ব্যবসা ‘মেড ইন চায়না’ বা ‘মেড ইন আমেরিকা’ হবে না, ‘মেড ইন ইন্টারনেট’ হবে। আমাদেরকেও পরিবর্তন হতে হবে। আগামী ত্রিশ বছরে পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন আসবে। প্রযুক্তি পৃথিবীর সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনবে। প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সামাজিক পরিবর্তনে নিতে আমাদের এখন থেকেই পরিবর্তন হতে হবে।
সব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আমার কাছে শিক্ষা বিষয়ক প্রতিবন্ধকতা বেশি কঠিন বলে মনে হয়। বিশ্ব সেরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ও একই প্রতিবন্ধকতা দেখছে। আমরা আমাদের শিশুদের গত ২০০ বছরের বিষয়ই শেখাচ্ছি। আমরা তাদের যা শেখাই তা কিন্তু যন্ত্র ভালো করবে। আমাদের আসলে চিন্তা করতে হবে আমাদের সন্তানদের আমরা ভবিষ্যতে কি শেখাবো। আমাদের শিশুদের এমনভাবে শেখাতে হবে যেন যন্ত্র তাদের পরাজিত করতে না পারে। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে যন্ত্রের শুধু কাঠামো থাকবে, আর মানুষের থাকবে হৃদয়।
আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। ভবিষ্যতে আসলে জ্ঞানভিত্তিক কোন প্রতিযোগিতা থাকবে না, তখন থাকবে সৃজনশীলতার প্রতিযোগিতা। তখন থাকবে কল্পনার প্রতিযোগিতা। তখন থাকবে শেখার প্রতিযোগিতা। তখন থাকবে উন্মুক্ত চিন্তার প্রতিযোগিতা। আপনি যখন থেকে যন্ত্রের মত চিন্তা করা শুরু করবেন, তখন থেকেই সমস্যার শুরু হবে। গত বিশ বছর ধরে কিন্তু আমরা মানুষকে যন্ত্র বানিয়েছি। আগামী বিশ বছরে যন্ত্রকে মানুষের মত লাগবে। আসলে ভবিষ্যত জ্ঞাননির্ভর হবে না, প্রজ্ঞানির্ভর হবেন। ভবিষ্যত হবে অভিজ্ঞতা নির্ভর। অতীত ছিল উৎপাদন নির্ভর, ভবিষ্যত হবে সৃজনশীল নির্ভর। যে কারণে পৃথিবীকে মানসিক বুদ্ধিমত্তা, আবেগকেন্দ্রিক বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি এলকিউ গুরত্ব দিতে হবে। এলকিউ হচ্ছে লাভ, ভালোবাসা। আপনি যখন অন্যদের নিয়ে ভাববেন, অন্যের সাফল্য নিয়ে চিন্তা করবেন তখনই আপনি জিতবেন।
সবাইকে ধন্যবাদ।
২০১৮ সালে হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া সমাবর্তন বক্তব্যের অনুবাদ।
-- Stay cool. Embrace weird.